হিসাববিজ্ঞানের মৌলিক ধারণা Basic Concept in Accounting, হিসাববিজ্ঞানের উৎপত্তি ও লুকা প্যাসিওলির অবদান। আমার এই আলোচনাটা একাদশ শ্রেণীর নবীন ছাত্রছাত্রীদের হিসাববিজ্ঞান সম্পর্কে মৌলিক ধারনা দেওয়ার উদ্দেশ্য। আগামী ১লা জুলাই থেকে আপনাদের কলেজ জীবন শুরু হবে। আমার পক্ষ থেকে আপনাদের জন্য অগ্রিম অভিনন্দন রইল।
আশা করি নবম-দশম কিংবা হিসাববিজ্ঞানের যেকোন শিক্ষার্থীদের জন্যও এই আলোচনাটা অনেক কার্যকরী হবে।
হিসাববিজ্ঞান নিয়ে আলোচনার শুরুতেই আমরা জেনে নিব হিসাববিজ্ঞান কি?
হিসাববিজ্ঞান হচ্ছে একটি তথ্য ব্যবস্থা যা কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনগুলো চিহ্নিত করে লিপিবদ্ধকরণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে আর্থিক ফলাফল প্রকাশ করে এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে।
=== হিসাববিজ্ঞানের উদ্দেশ্য:
> হিসাববিজ্ঞানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে লেনদেন চিহ্নিতকরণ ও লিপিবদ্ধকরণ।
> হিসাববিজ্ঞানের মূখ্য/প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করা।
হিসাববিজ্ঞানের উৎপত্তি:
অতি প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ লেনদেনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ও বিভিন্ন প্রকারে তা সংরক্ষণের পদ্ধতি বের করে । দক্ষিণ আফ্রিকার একটি প্রাচীন গুহা থেকে উদ্ধারকৃত কিছু লিপি থেকে বোঝা যায় যে প্রায় ৭৬,০০০ বছর আগেও মানুষ হিসাব সংরক্ষণের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল। এটি ছিল হিসাববিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন।
হিসাববিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনগুলি পাওয়া যায় ব্যাবিলনিয়, এশিরীয় ও সুমেরীয় সভ্যতায়। এই সভ্যতাগুলো প্রায় ৭,০০০ বছর পূর্বে মেসোপটেমিয়া নদীর তীরে গড়ে ওঠে এবং বিকাশ লাভ করে।
উক্ত সভ্যতার লোকেরা শুধুমাত্র কৃষি উৎপাদন পরিমাপ করতেই হিসাবের আদিম পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করত। সেই আদিম পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে ফসল গত বছরের তুলনায় কম হয়েছে না বেশি হয়েছে তা নির্ণয় করা যেতো। উৎপাদিত ফসলের একটি অংশ মন্দিরে দান করতে হতো। আর কে কতোটুকু দান করল মন্দির কর্তৃপক্ষ তা দেওয়ালে চিহ্নের মাধ্যমে লিখে রাখতো। এই প্রাচীন দেওয়াল খোদাইগুলোকেও হিসাব বিজ্ঞানের প্রাচীন প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে।
প্রস্তর যুগে মানুষ যখন গুহায় বাস করত এবং ফলমূল ও পশু শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত তখনই তারা এগুলো গুহার অভ্যন্তরে পাথরের গায়ে দাগ কেটে হিসাব রাখত।
প্রাচীনযুগে মানুষ গুহা ছেড়ে সমভূমিতে বসবাস শুরু করে। এ যুগে মানুষ গুহায় পাথরের গায়ে দাগ কাটার পরিবর্তে ঘরের দেয়ালের গায়ে দাগ কেটে, রশিতে গিট বেধে, বাঁশে দাগ কেটে, মাটির টিলা গননা করে হিসব রাখত।
হিসাববিজ্ঞানে লুকা প্যাসিওলির অবদান:
১৪৯৪ সালে ইতালির ভেনিস নগরীতে ইতালীয় রেনেসাঁর গণিতজ্ঞ ও ধর্মযাজক লুকা প্যাসিওলি (Luca Pacioli) বৈজ্ঞানিক হিসাবশাস্ত্রের প্রচলন করেছিলেন। লুকা প্যাসিওলি ছিলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি’র একজন নিকটতম বন্ধু ও গৃহশিক্ষক এবং ইতালীয় নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস এর সমসাময়িক।
লুকা প্যাসিওলি’র ১৪৯৪ সালের মূলপাঠ ল্যাটিন ভাষায় প্রকাশিত গ্রন্থ (‘Summa de Arithmatica, Geometrica, Proportioni et proportionalita) সুম্মা ডি এরিথিমেটিকা, জিওমেট্রিকা, প্রপোরসোনিয়েট প্রোপোরসনালিটাতে দুতরফা দাখিলা পদ্ধতি (Double Entry System) সম্পর্কে আলোকপাত করেছিলেন।
তার এই গ্রন্থে মোট ১০ টি অধ্যায় (Ten Chapters) ছিল। প্রথম সাতটি অধ্যায় পাটিগনিত(Arithmetic), ৮ম অধ্যায়ে বীজগনিত (Algebra), ৯ম অধ্যায়ে ব্যবসায় ও বাণিজ্য ( Business & Trade) এবং ১০ম অধ্যায়ে ব্যবহারিক জ্যামিতি ( Practical Geometry) সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
বইটির তৃতীয় অংশে De Computis et Scripturis শিরোনামের অধ্যায়গুলোতে (৩৬ টি অধ্যায়) দুতরফা দাখিলা পদ্ধতি (Double Entry Bookkeeping System), রেওয়ামিল (Trial Balance), উদ্বর্ত-পত্র ( Balance Sheet) ও হিসাববিজ্ঞানের অন্যান্য কিছু বিষয়ের (Various other tools) সম্পর্কে আলোচনা ছিল। তথ্যসূত্র: Wikipedia.
দুতরফা দাখিলা পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছিল ” Every Debit must have an equal & corresponding Credit” অর্থাৎ প্রত্যেকটি ডেবিটের সমপরিমাণ ও বিপরীত ক্রেডিট থাকবে।
লুকা প্যাসিওলির এই আলোচনার সূত্র ধরেই আধুনিক হিসাববিজ্ঞানের উৎপত্তি হয়েছে। এজন্য লুকা প্যাসিওলিকে হিসাববিজ্ঞানের জনক বলা হয়।
লুকা প্যাসিওলির জন্ম হয় ১৪৪৭ খ্রিস্টাব্দে এবং মৃত্যু হয় ১৫১৭ সালে।
তার জন্মস্থানের নাম Borgo Santo Sepolcro, Tuscany অনুসারে তাকে Luca di Borgo নামেও চিনে। তবে তার পুরো নাম Fra Luca Bartolomeo de Pacioli কখনো কখনো Luca de Paciolo ও বলা হয়।
আজ আমরা হিসাববিজ্ঞান কি, এর উদ্দেশ্য, হিসাববিজ্ঞানের উৎপত্তি ও লুকা প্যাসিওলির অবদান সম্পর্কে জানলাম। এই আলোচনা থেকে MCQ অংশে প্রশ্ন থাকবে। পরবর্তী আলোচনা হবে আধুনিক হিসাববিজ্ঞান ও হিসাব সমীকরণ নিয়ে।
প্রয়োজনে খুজে পেতে শেয়ার করুন এবং আপনার বন্ধুদের Mention করুন।
আমার এই আলোচনাটা একাদশ শ্রেণীর নবীন ছাত্রছাত্রীদের হিসাববিজ্ঞান সম্পর্কে মৌলিক ধারনা দেওয়ার উদ্দেশ্য।
তাছাড়াও নবম-দশম কিংবা হিসাববিজ্ঞানের যেকোন শিক্ষার্থীদের জন্য এই আলোচনাটা অনেক কার্যকরী হবে।
আজকের আলোচনা আধুনিক হিসাববিজ্ঞান ও হিসাব সমীকরণ।
আধুনিক হিসাববিজ্ঞান বলতে আমেরিকান হিসাববিজ্ঞান (American Accounting) কে বুঝায়। পূর্বে আমাদের দেশে ব্রিটিশ হিসাববিজ্ঞান (British Accounting) এর প্রচলন ছিল যা সনাতন হিসাববিজ্ঞান নামে পরিচিত।
আধুনিক বা আমেরিকান হিসাববিজ্ঞানের মূল ভিত্তি হচ্ছে হিসাব সমীকরণ।
<> হিসাব সমীকরণ:
হিসাব সমীকরণ বলতে একটি প্রতিষ্ঠানের সম্পদের উপর মালিক ও তৃতীয় পক্ষের দাবির গানিতিক প্রকাশকে বুঝায়।
মৌলিক হিসাব সমীকরণটি হচ্ছে:-
A=L+OE
Here,
A= Assets (সম্পদ)
L= Liabilities(দায়)
OE= Oowner’s Equity(মালিকানা স্বত্ব)
> সম্পদ (Assets) :
একটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বিভিন্ন উপকরণ যায় আর্থিক সুবিধা আছে এবং ব্যবহারের উপযোগিতা আছে তাকে সম্পদ বলে।
যেমন: নগদ টাকা, ব্যাংক জমা, প্রাপ্য মজুদ পণ্য, আসবাবপত্র, দালানকোটা ইত্যাদি।
> দায় (Liabilities) :
প্রতিষ্ঠানের সম্পদের উপর মালিক ছাড়া তৃতীয় পক্ষের দাবিকে দায় বলে।(তৃতীয় পক্ষ বলতে মালিক ছাড়া অন্য যে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বুঝায়।)
দায় মূলত সম্পদের উপর প্রতিষ্ঠানের বাহিরের পক্ষের দাবি। তাই দায়কে বহির্দায় ( External Liabilities) বলা হয়।
যেমন: প্রদেয় হিসাব, ব্যাংক জমাতিরিক্ত, ব্যাংক ঋণ ইত্যাদি।
> মালিকানা স্বত্ব (Owner’s Equity) :
প্রতিষ্ঠানের সম্পদের উপর মালিকের দাবিকে মালিকানা স্বত্ব বলে। মালিক প্রতিষ্ঠানের ভিতরের পক্ষ। তাই মালিকানা স্বত্বকে অন্তর্দায় (Internal Liabilities) বলে।
যেমন: মালিকের মূলধন।
নোট: ব্যবসায় স্বত্বা ধারণা ( Business Entity Concept) অনুযায়ী মালিক এবং ব্যবসা পৃথক স্বত্বার অধিকারী, এজন্য মালিকের মূলধনকে ব্যবসায়ের অন্তর্দায় হিসেবে গণ্য করা হয়।
পরবর্তী আলোচনা হবে হিসাব সমীকরণের বর্ধিত রূপ ও হিসাবের স্বাভাবিক উদ্বৃত্ত (Normal Balance of Accounts)