স্যাটেলাইটের কি।স্যাটেলাইট এর কাজ কি? বঙ্গবন্ধু-স্যাটেলাইট আমাদের কি কাজে আসবে।
স্যাটেলাইট এমন একটি কৃত্রিম বস্তু যা ইচ্ছাকৃতভাবে কক্ষপথে স্থাপন করা হয়েছে যেমন চাঁদ, বা মানুষের বডি (বা extraterrestrial)। স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের খবর আমরা মুহুর্তের মধ্যে পেয়ে যাই।
স্যাটেলাইটকে রকেট বা স্পেস শাটলের কার্গো বে-এর মাধ্যমে কক্ষপথে পাঠানো হয়।
পাঠানোর সময় রকেট নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হয় ইনার্শিয়াল গাইডেন্স সিস্টেম (আইজিএস) মেকানিজম।
পৃথিবীর অভিকর্ষ পার হতে রকেটকে ঘণ্টায় ২৫ হাজার ৩৯ মাইল ত্বরণে ছুটতে হয়।
স্যাটেলাইট স্থাপনের সময় কক্ষীয় গতি ও তার জড়তার ওপর পৃথিবীর অভিকর্ষের যে প্রভাব রয়েছে, এর জন্য সামঞ্জস্য বিধান করতে না পারলে স্যাটেলাইট এ অভিকর্ষের টানে ফের ভূপৃষ্ঠে চলে আসতে পারে।
এ জন্য স্যাটেলাইটকে ১৫০ মাইল উচ্চতাবিশিষ্ট কক্ষপথে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১৭ হাজার মাইল গতিতে পরিভ্রমণ করানো হয়।
মূলত গতিবেগ কত হবে, তা নির্ভর করে স্যাটেলাইটটি পৃথিবী থেকে কত উচ্চতায় রয়েছে, তার ওপর।
পৃথিবী থেকে ২২ হাজার ২২৩ মাইল উপরে স্থাপিত স্যাটেলাইট ঘণ্টায় ৭০০ মাইল বেগে পৃথিবীকে আবর্তন করে।
পৃথিবীর সঙ্গে স্যাটেলাইটও ২৪ ঘণ্টা ঘোরে। তবে ভূ-স্থির বা জিওস্টেশনারি উপগ্রহগুলো এক জায়গাতেই থাকে।
এগুলো আবহাওয়া ও যোগাযোগ সংক্রান্ত কাজে ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীর কক্ষপথে স্যাটেলাইট উপবৃত্তাকার পথে ঘোরে।
সাধারণত ৮০-১ হাজার ২০০ মাইল উচ্চতাবিশিষ্ট কক্ষপথে বিভিন্ন ধরনের স্যাটেলাইট পাঠানো হয়। কাজের ধরনের ওপর নির্ভর করে
স্যাটেলাইটটি কত উচ্চতায় বসবে। যেমন উদ্ভিদ ও প্রাণী নিয়ে গবেষণা, বণ্যপ্রাণীর চরে বেড়ানো পর্যক্ষেণ, অ্যাস্ট্রোনমি এবং পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করার জন্য সায়েন্স স্যাটেলাইটকে বসানো হয় ৩০ হাজার থেকে ৬ হাজার মাইল উচ্চতায়। আবার গোবাল পজিশনিং
সিস্টেম (জিপিএস) স্যাটেলাইট স্থাপন করা হয় ৬ হাজার থেকে ১২ হাজার মাইল উচ্চতায়। এক এক ধরনের স্যাটেলাইটের
বৈশিষ্ট্য ও গঠন প্রণালী একেকরকম। তবে সব স্যাটেলাইটের মধ্যেই সাধারণত কিছু মিল আছে।স্যাটেলাইট এর বার্ড আই ভিউ(পাখির মত ভূ-পৃষ্ঠের অনেক ওপর থেকে দেখা) এর কারণে আমরা উপর থেকে পৃথিবীর একটি বৃহৎ অংশ দেখতে পাই। এই কারণে ভু-পৃষ্ঠে স্থাপিত কোনো যন্ত্রের চেয়ে অধিক দ্রুত এবং নিখুঁত তথ্য সংগ্রহ করতে পারে স্যাটেলাইট। এমনকি কোনো বস্তু পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে স্যাটেলাইট টেলিস্কোপ এর চেয়ে অধিক কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। স্যাটেলাইটকে এত উপরে স্থাপনের মুল কারণ হল যাতে মেঘ, ধুলাবালি কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করতে পারে। স্যাটেলাইট স্থাপনের পূর্বে টিভি সিগন্যাল বেশি দূর যেতে পারতো না। কারণ, টিভি সিগন্যাল সরলরেখা বরাবর কাজ করে।
এখন টিভি সিগন্যাল, ফোন কল প্রথমে পৃথিবী থেকে স্যাটেলাইটে পাঠানো হয়। স্যাটেলাইট সিগন্যাল গ্রহণের পর তৎক্ষণাৎ সেটি আবার পৃথিবীতে আমাদের প্রত্যাশিত স্থানে ফেরত পাঠায়।
স্যাটেলাইট এর গঠন
স্যাটেলাইট বিভিন্ন আকৃতির হতে পারে। প্রত্যেক স্যাটেলাইট এর ২টি সাধারণ অংশ থাকে অ্যান্টেনা এবং শক্তির উৎস।
অ্যান্টেনা তথ্য গ্রহণ ও সংগ্রহের কাজ করে থাকে। সোলার প্যানেল অথবা ব্যাটারি, উভয়েই শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে।
নাসা’র স্যাটেলাইটে ক্যামেরা এবং কিছু সেন্সর লাগানো থাকে ।
স্যাটেলাইট কিভাবে পাঠানো হয়
কক্ষপথে স্যাটেলাইট স্থাপন করার জন্য আলাদা মহাশূন্য যান রয়েছে। একে বলা হয় “উৎক্ষেপণ যন্ত্র (Launch Vehicle)“।
কক্ষপথে স্যাটেলাইট স্থাপনের ক্ষেত্রে যে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি মাথা ঘামাতে হয়, তা হলো অভিকর্ষজ ত্বরণ এবং মহাশূন্য যানটির গতির সমতা রক্ষা করা। কারণ অভিকর্ষজ ত্বরণ আমাদের উৎক্ষেপণ যন্ত্রকে পৃথিবীর দিকে টানতে থাকে।
দুই ধরনের উৎক্ষেপণ যন্ত্র রয়েছে – অপচয়যোগ্য রকেট এবং মহাশূন্য শাটল।
অপচয়যোগ্য রকেটগুলো স্যাটেলাইট স্থাপন শেষে ধ্বংস হয়ে যায়। অপরদিকে মহাশূন্য শাটলগুলো স্যাটেলাইট স্থাপনের কাজে বারবার ব্যবহার করা যায়। উৎক্ষেপণ যন্ত্রের গতিবেগ উচ্চতার উপর অনেকটা নির্ভর করে।
কম উচ্চতার কক্ষপথে (Low Earth Orbit = LEO) এর বেগ ৭.৮ কি.মি./সেকেন্ড, বেশি
উচ্চতার কক্ষপথে (Geostationary Earth Orbit =GEO) এর বেগ ৩.১ কিমি/সে ।
স্যাটেলাইটের প্রকারভেদ
কক্ষপথ এর ভিত্তি করে স্যাটেলাইট সিস্টেম কে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়।
- LEO ( Low Earth Orbit ) – পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ১৬০-২০০০ কি.মি. উপরে অবস্থিত। সাধারণত পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণকারী স্যাটেলাইটগুলো এই কক্ষপথে থাকে। পৃথিবী পৃষ্ঠের খুব কাছে থাকায় এই কক্ষপথে থাকা স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারে। আন্তর্জাতিক স্পেস ষ্টেশন এই কক্ষপথে অবস্থিত।
- MEO ( Medium Earth Orbit) – পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ২০০০০ কি.মি. উপরে অবস্থিত। সাধারণত জিপিএস স্যাটেলাইট গুলো এই কক্ষপথে থাকে। এই কক্ষপথের স্যাটেলাইট গুলোর গতিবেগ মন্থর। এই স্যাটেলাইটগুলো পাঠাতে অনেক শক্তির প্রয়োজন হয়।
- GEO (Geostationary Earth Orbit) – GEO পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ৩৬০০০ কি.মি. উপরে অবস্থিত। এই কক্ষপথে অ্যান্টেনা এর অবস্থান নির্দিষ্ট থাকে। সাধারণত রেডিও এবং টিভি এর ট্রান্সমিশনের কাজে ব্যাবহার করা হয়।
স্যাটেলাইট এর অন্যান্য ব্যবহার
- স্যাটেলাইট খামার গুলোর ডিজিটাল মাপ তৈরি করে । ফলে কৃষক দের মাটির গুনাগুণ , ফসলের ফলন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেয়।
- সড়ক দুর্ঘটনার কারণে প্রতি বছরই অনেক মানুষ মারা যায়। স্যাটেলাইট এর মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন সড়কের খুঁতগুলো বের করতে পারি।
- নগরায়ন এর কাজে অনেক অনেক উপকারে আসে।
- এখন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নানাবিধ পণ্য আমদানি রপ্তানি হয়। ঘরে বসেই এদের অবস্থান ট্র্যাক করতে স্যাটেলাইট আমাদের সাহায্য করে ।
- বাতাসের বেগ এবং বায়ু দূষণের পরিমাণ নির্ণয়ে স্যাটেলাইট আমাদের সাহায্য করে থাকে।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর ক্ষতিগ্রস্থদের সাহায্য করার কাজে স্যাটেলাইট সবচেয়ে বেশি কাজে আসে।
বিশ্বের ১০ টি দেশে স্যেটেলাইট লঞ্জ করার ক্ষমতা আছে।
স্যাটেলাইট নিয়ে আরো কিছু কথা
- ১৯৫৭ সালের অক্টোবর মাসে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন স্পুটনিক-১ নামে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে
- ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন স্পুটনিক-২ নামে আরেকটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে যাতে ছিল লাইকা নামে একটি কুকুর।
- ১৯৫৮ সালের ১-লা জানুয়ারি আমেরিকা প্রথম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে এক্সপ্লোরার-১ নামে।
- একটি স্যাটেলাইট কে কক্ষপথে তার অবস্থান ধরে রাখার জন্য একটি নির্দিষ্ট গতিবেগ দরকার। এটি হচ্ছে ২৮,২০০ কিমি/ ঘন্টা ।
- ২০০৯ সালে একটি আমেরিকান এবং একটি রাশিয়ান স্যাটেলাইট এর মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে।
- স্যাটেলাইট খুব ছোট ও হতে পারে। যেমন ১০ সেন্টিমিটার সাইজ এর।
- স্যাটেলাইট কে মিসাইল এর মাধ্যমে ধ্বংস করাও যেতে পারে।
আশার কথা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু-১ নামে একটি স্যাটেলাইট প্রথম বাংলাদেশী ভূ-সমলয় যোগাযোগ স্যাটেলাইট যা বাংলাদেশ
টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন দ্বারা পরিচালিত হবে। এটি ২০১৭ সালে উৎক্ষেপণ করা হবে। এটি 119° পূর্ব দ্রাঘিমাংশে ভূ-সমলয় স্লটে অবস্থিত করা হবে বলে আশা করা হয়। ফ্রান্সের থেলাস এলেনিয়া স্পেস কোম্পানি এটি তৈরি করবে। এটি তৈরিতে খরচ হবে ২৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (১৯৫১ কোটি টাকা)। সুদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের দেশ থেকেই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা যাবে ।